আখলাকে যামিমাহ অর্থ নিন্দনীয় চরিত্র। আখলাকে যামিমাহ বলতে মানুষের মন্দ আচরণ যেমন- মিথ্যা বলা, প্রতারণা, ধোঁকা, ঈর্ষা, হিংসা, লোভ, গিবত, গালি ও মন্দ কথা, অম্লীলতা, অপচয়, অহংকার, ক্ষতিকর আসক্তি ইত্যাদিকে বোঝায়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, "দুষ্ট ও কঠোর স্বভাবের ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না।' (আবু দাউদ)
আখলাকে যামিমাহ আত্মিক ও মানসিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন করে। যার মধ্যে মন্দ আচরণ বিদ্যমান সে সকলের কাছে ঘূর্ণিত। এরা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে থাকে। একজন পূর্ণাঙ্গ মুমিন হতে গেলে অবশ্যই মানুষকে আখলাকে যামিমাহ বর্জন করতে হবে। প্রিয় শিক্ষার্থী, চলো আমরা কতিপয় আখলাকে যামিমাহ বা নিন্দনীয় চরিত্র সম্পর্কে জেনে নেই।
যা সত্য নয় তা-ই মিথ্যা। কথা ও কাজে জেনেশুনে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করা একটি মন্দ আচরণ। মিথ্যাকে সকল পাপ কাজের জননী বলা হয়। একটি মিথ্যা থেকে অসংখ্য মিথ্যার জন্ম হয়। তাই কোনভাবেই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। কেননা, বিক্রি করার সময় মিথ্যা বলা, ওজনে কম দেওয়া কিংবা ভেজাল দেওয়াসহ নানা রকম প্রতারণা করা উচিত নয়। এমনকি হাসি-ঠাট্টার মাধ্যমেও মিথ্যা বলা যাবে না।
মিথ্যার পরিণাম
মিথ্যা একটি জঘন্য অপরাধ। এটি একটি কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। মিথ্যা সকল পাপের মূল। প্রতারণা, প্রবঞ্চণা ও অন্যের সম্পদ আত্মসাতসহ সকল অনৈতিক ও সমাজবিরোধী কর্মের মূলে রয়েছে মিথ্যাচার। যে সমাজে মিথ্যাচার বৃদ্ধি পায়, সে সমাজ ক্রমে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়।
মিথ্যাচার একটি নিন্দনীয় আচরণ। মিথ্যাবাদীকে কেউ বিশ্বাস করে না এবং ভালোবাসে না। বিপদের সময় তাকে কেউ সাহায্য করতে আসে না। তার কথাকে কেউ গুরুত্ব দেয় না। মহান আল্লাহ তা'আলা তার উপর খুব অসন্তুষ্ট হন। মহান আল্লাহ বলেন: “আর তোমরা দূরে থাক মিথ্যা কখন থেকে।' (সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৩০)
পবিত্র কোরআনে বহু আয়াতে নানাবিধ মন্দ কাজ নিষেধ করা হয়েছে।
মহানবি (সা.) বলেন, 'তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাকবে। কেননা, মিথ্যা পাপাচার পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আর পাপাচার জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। ব্যক্তি যখন অনবরত মিথ্যা বলতে থাকে তখন আল্লাহর নিকট তাকে মিথ্যাবাদীরূপে লিপিবদ্ধ করা হয়।' (বুখারি ও মুসলিম)
মিথ্যা কথা বলা মুনাফিকের নিদর্শনও বটে। হাদিসে বলা হয়েছে,
أَيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلَاثٌ إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا أَوْ تُمِنَ خَانَ وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ
অর্থ: মুনাফিকের আলামত তিনটি- যখন সে কথা বলে তখন মিথ্যা বলে, আমানতের খেয়ানত করে এবং ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে।' (বুখারি ও মুসলিম)
অতএব, মিথ্যা সর্বদা পরিত্যাজ্য। আমারা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব কারো সাথেই মিথ্যা বলব না।
প্রতারণা হচ্ছে অসদুপায় অবলম্বন করে কোনো কিছু পাওয়ার চেষ্টা করা। প্রচলিত আইন বা নিয়ম-কানুনকে উপেক্ষা করে কিংবা ফাঁকি দিয়ে অসৎ উপায়ে কোনো কিছু অর্জন করাকে প্রতারণা বলে। আমাদের সমাজে বিভিন্ন রকমের প্রতারণামূলক কাজ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন- বিশ্বাস ভঙ্গ করা, মিথ্যা শপথ করা, ওজনে কম দেওয়া, পণ্য বিক্রিতে দোষ গোপন করা, পণ্যে ভেজাল দেওয়া, দেশে-বিদেশে চাকরি দেওয়ার মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, অন্যের হক নষ্ট করা, অফিস-আদালত ও লেনদেনে দুর্নীতি করা এবং পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করা ইত্যাদি।
প্রতারণার কুফল
প্রতারণা একটি জঘনা সামাজিক অপরাধ। প্রতারণার জন্য মানুষকে বিভিন্ন রকমের দুঃখ-কষ্ট ও অশান্তি ভোগ করতে হয়। প্রতারণা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সত্যিকার ইমানদার কখনোই প্রতারণার আশ্রয় নেয় না, মানুষকে ধোঁকা দেয় না এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না।
প্রতারণার কুফল সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِينَ الَّذِينَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُونَ وَإِذَا كَالُوهُمْ أَوْ وَزَنُوهُمْ يُخْسِرُونَ
অর্থ: 'দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। যারা লোকদের থেকে মেপে নেবার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে কিন্তু অন্যকে মেপে ও ওজন করে দেওয়ার সময় কম দেয়।' (সূরা মুতাফফিফীন, আয়াত: ১-৩)
আমাদের সমাজে নানারকম প্রতারণা দেখতে পাওয়া যায়। যে রূপেই প্রতারণা করা হোক না কেন, ইসলাম সেটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। লেনদেন ও বেচাকেনা কিংবা ওজনে কম দেওয়ার বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অসংখ্য হাদিস পাওয়া যায়। মহানবি (সা.) একবার বাজারে খেজুরের দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়: এর ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তার অভ্যন্তরে ভেজা খেজুর পেলেন। তখন তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক। এটি কী? জবাবে সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, বৃষ্টির কারণে ভিজে গেছে। এ কথা শুনে তিনি বললেন, “তুমি খেজুরগুলো উপরে রাখলে না কেন? তাহলে তো ক্রেতাগণ এর অবস্থা দেখতে পেত (প্রতারিত হতো না)। যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হবে না।' (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, জীবনের কোন কাজেই প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া যাবে। না। প্রতারণা একটি অপরাধ। একবার যদি কেউ প্রতারণা করে তবে তাকে কেউ আর বিশ্বাস করে না। একবার বিশ্বাস ভঙ্গ হলে আর কোনোভাবেই সে বিশ্বাস তৈরি করা যায় না। প্রতারনা করে আপাতদৃষ্টিতে কিছু অর্জন করতে পারলেও তার সার্বিক ফল ভালো হয় না। একজন মুসলমান কখনই অন্য কাউকে ধোঁকা দিতে পারে না। তাইতো ধোঁকা ও প্রতারণামুক্ত সমাজ গড়তে আমাদের সকলকে ইমানি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে।
গিবত একটি সামাজিক অনাচার। কারও অগোচরে তার দোষ-ত্রুটি অন্যের কাছে প্রকাশ করাকে গিবত বলে। একে পরনিন্দাও বলা হয়। গিবত একটি ঘূর্ণিত ও জঘন্য কাজ। এটি কবিরা গুনাহ। এ থেকে বিরত থাকা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'গিবত কী তা কি তোমরা জানো?” লোকেরা উত্তরে বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই ভালো। জানেন। রাসুলুল্লাহ (সা.] বললেন, 'গিবত হলো তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে তার অগোচরে তোমার এমন কথা বলা যা সে অপছন্দ করে। জিজ্ঞাসা করা হলো, আমি যা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, এটাও কি গিবত হবে?”
রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, 'তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলেই দিতে হবে। আর তুমি যা বলো তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তা হবে অপবাদ।' (মুসলিম) গিবত একটি নিন্দনীয় কাজ। গিবতের মাধ্যমে মানুষে মানুষে ঘৃণা ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে সমাজ জীবনে ঝগড়া-ফাসাদসহ নানা অশান্তি সৃষ্টি হয়। পবিত্র কুরআনুল কারীমে গিবত করাকে মুক্ত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন,
وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضًا أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا
فَكَرِهْتُمُوهُ
অর্থ: 'তোমরা একে অপরের পশ্চাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে, নিশ্চয়ই তা তোমরা অপছন্দ করবে।' (সূরা আল হুজুরাত, আয়াত: ১২)
গিবত করার মতো গিবত শোনাও পাপের কাজ। কেউ গিবত করলে তাকে গিবত থেকে বিরত রাখা কর্তব্য। তাহলে গিবতচর্চা সমাজ থেকে দূরীভূত হবে।
সর্বাবস্থায়ই গিবত বা পরনিন্দা থেকে মুক্ত হতে হবে। কারণ, কোনও অবস্থায়ই গিবত জায়েজ বা বৈধ নয়। কেউ যদি গিবত করে তবে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যার গিবত করা হয়েছে তার থেকে অবশ্যই মাফ করিয়ে নিতে হবে। আর সে যদি মারা যায়, তার থেকে ক্ষমা চাওয়া সম্ভব না হয়, তবে আল্লাহর নিকট তার গুনাহ মাফের দোয়া করতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'নিঃসন্দেহে গিবতের একটি ক্ষতিপূরণ হলো, তুমি যার গিবত বা কুৎসা রটনা করেছ তার জন্য এভাবে দোয়া করবে: হে আল্লাহ তুমি আমার ও তার গুনাহ মাফ করে দাও।
গিবত বা পরনিন্দা ইমান ও আমল ধ্বংস করে দেয়। মানুষের মধ্যে একতা নষ্ট হয়, অন্যের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়। পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতি নষ্ট হয়। ফলে সমাজে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যে গিবত করে। তার ভালো আমলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। তাইতো সর্বদা গিবত বা পরনিন্দা থেকে দূরে থাকতে হবে। সমাজ থেকে গিবত দূর করতে আমাদের সকলকে একত্র হয়ে কাজ করতে হবে। না হয় সংক্রামক ব্যাধির মতো সমাজে গিবত বৃদ্ধি পাবে। তা সমাজের জন্য মহা অমঙ্গলের কারণ হবে।
কাউকে মন্দ নামে ডাকা, মন্দ কথা বলা, তিরস্কার করা, অশালীন বা অভীল কথা বলা হলো গালি দেওয়া। এটি একটি নিন্দনীয় কাজ। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে-
بئسَ الِاسْمُ الْفُسُوقُ بَعْدَ الْإِيْمَانِ
অর্থ: ইমান আনয়নের পর মন্দ নামে ডাকা অতিশয় গর্হিত কাজ।' (সুরা আল হুজুরাত, আয়াত: ১১)
মানুষ সভ্য জাতি, তারা কাউকে গালি দেবে না। সমাজে একত্রে বসবাস করতে হলে পরস্পরের সঙ্গে মতের অমিল থাকতে পারে। একে অপরের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিও হতে পারে। একের সঙ্গে অন্যের কথা কাটাকাটি হতে পারে। তা সত্ত্বেও একে অন্যকে অশালীন বা অশ্রীল কথা বলে গালি দেওয়া উচিত নয়। অশালীন কথা বলা নিতান্তই খারাপ কাজ। যে গালি দেয় ও অশালীন কথা বলে, সে সমাজে ঘৃণিত। তাকে মানুষ পছন্দ করে না। সমাজে তার কোনো সমাদর থাকে না। তার সঙ্গে কেউ বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে না। আমাদের প্রিয়নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) গালি দিতে বা গালাগাল করতে নিষেধ করেছেন।
একবার মহানবি (সা.) কাছে এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে আমার সম্প্রদায়ের এমন এক ব্যক্তি গালি দেয়, যে আমার থেকে নিচু। এর প্রতিশোধ নিতে আমার কোনো বাধা আছে কি? রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন, পরস্পর গালমন্দকারী উভয়েই শয়তান। তারা পরস্পরকে মিথ্যাবাদী বলে এবং একে অপরকে দোষারোপ করে।' (বুখারি ও মুসলিম)
গালি সম্পর্কে আরও বলেছেন, মাতাপিতাকে গালি দেওয়া মহাপাপ। সাহাবিগণ বললেন, 'হে আল্লাহর রাসুল! এমন কোনো নরাধম আছে যে আপন মাতাপিতাকে গালি দেয়?” তিনি বললেন, 'যে ব্যক্তি অপরের মাতাপিতাকে গালি দেয় এবং এজন্য সে-ও তার মাতাপিতাকে গালি দেয়।' (বুখারি ও মুসলিম)
এ হাদিস শরিফ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, অন্যের মাতাপিতাকে গালি দেওয়া মানে নিজের মাতাপিতাকে গালি শোনানো। সমাজকে গালিমুক্ত করতে গালির উত্তরে গালি দেবো না, এতে গালমন্দকারী লজ্জিত ও অনুতপ্ত হবে। গালমন্দ ভালো কাজ নয়, গালমন্দের মতো অশালীন কাজ হতে আমরা বিরত থাকব।
অনেক তো ভালো কাজ আর মন্দ কাজ সম্পর্কে জানা হলো। এবার তাহলে একটা আনন্দের কাজ করা যাক। এসো এবারে বন্ধুরা মিলে একটি পল্প বলার আসরের আয়োজন করি।
ক্লাসের বন্ধুরা মিলে এবার একটি গল্প বলার আসরের আয়োজন করবে। সেখানে তোমরা এতদিন যেসকল আখলাকে হাসিনা আর আখলাকে যামিমাহা এর ব্যাপারে জেনেছ সেগুলো নিয়ে আলোচনা করবে। তুমি বা তোমার পরিচিত কেউ কিভাবে প্রতিদিন আপনাকে হাসিনাহা এর চর্চা করেছে তার পর বলবে। আপনাকে যামিমাহ গুলো থেকে দূরে থাকতে তুমি কি কি কাজ করছ, অন্যকে কিভাবে সহায়তা করছ সেই গল্প বলবে। আর বন্ধুদের গল্পগুলোও শুনবে। ব্যাস, এটাই কাজ।
তোমাদের ইসলাম শিক্ষা বিষয়ক শ্রেণির কাজের সময় থেকে একটা দিন ঠিক করে নিয়ে সেদিন তোমরা এই গল্প বলার কাজগুলো করবে। নিজেরা গল্প বলবে, অন্যের গল্প শুনবে। শিক্ষকও তোমাদের সাথে গল্প বলার কাজে অংশগ্রহণ করবেন।
আরও দেখুন...